ধারাবাহিক উপন্যাসঃ “ডাঙ্গুলী” ----খোশবুর আলী ( পুর্বঃ “উনিশ”)
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ “ডাঙ্গুলী”
----খোশবুর আলী
পুর্বঃ “উনিশ”
তারিখঃ ১৫/০৬/২০২০
উবিশ শত ঊন্নব্বই সালের ১লা মে। খুব গরম পড়েছে এবার। বৈদ্যপুর গ্রামের মাঠগুলি ধুধু মরুভুমির মত খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কোন জন মানুষের চিহ্ন নাই। প্রচন্ড খরায় গাছের ডালে পাখিরা পাখা মেলে মুখ হা করে গরমটাকে সামান্য হালকা করার চেষ্টা করছে।
গ্রামের লোকজন সব নিজ নিজ গৃহে দুপুরের ঘুমে ব্যাস্ত। গ্রামের মাটির বাড়িতে খড়ের ছাওনি থাকায় ঘরে খুব একটা গরম থাকেনা। গাছে গাছে আমের কড়ালি(কচি কচি আম) ঝুলছে।
কিছু দুষ্টু ছেলের দল তখনও বাবা মাকে ফাঁকি দিয়ে জড় হল কাশেমের আম গাছের নিচে।সকলের হাতে লাটিম। তারা হৈ চৈ করে লাটিম খেলছিল।মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া বইছে।
দমকা হাওয়ার সাথে সাথে ঘুর্নি বায়ু গ্রামের পোড়া ধুলি মাটি গুলি বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়। দুষ্টু ছেলেরাও চোখ বন্ধ করে অনেকে ঢুকে পড়ল সেই ঘুর্ণির মধ্য সাহস দেখাবার জন্য। গায়ে অনেক ধুলা লেগে গেল, এটা কোন ব্যাপার না, কাপড় খুলে দল বেঁধে ঝাঁপা ঝাঁপি শুরু করল নতুন পুকুরে। সারা গ্রাম জুড়ে গোসল করার উপযোগী একটি মাত্র পুকুর।
এবার সেখানে চলতে থাকলো গাছে উঠে পানিতে লাফ মারা। কে কত উপরের ডাল থেকে লাফ দিতে পারে চলছে সেই প্রতিযোগীতা । কখনও বা হরি খেলা , পানি ছেটানো কাদা ছোঁড়া, প্রায় ঘন্টা খানেক ডুব পাড়ার পর কেউ একজন বলল চলরে, লাটিম খেলি।
এমন সময় মান্নানের দাদি হাতে একটি লাঠি নিয়ে ছুটে এলো পাড়ে। সবাইকে গালি দিয়ে বলতে লাগল,
পানি ঘুলায়্যা কইরলু কি? উঢ্যা আয় দ্যাঘাচ্ছি মজা। ছেলেরা পানি থেকে না উঠে সাঁতরিয়ে চলে গেল অন্য পাড়ে।
তাদের সাথে পারবেনা দেখে বুড়ি মানুষটি সকলের কাপড় জটিয়ে নিয়ে চলল বাড়িতে।
ওপাড় থেকে ছেলেরা দেখল মান্নানের দাদি নাই, তাই তারা আবার আগের পাড়ে ফিরে এল। এবার উপরে উঠে দেখল কারও কাপড় নাই। এখন উপায় কি?
সবাই এখুন ল্যাংটা । কোন কাপড় নাই ফলে মাথা মোছার কোন বালাই নাই।
কিছুক্ষন পরে শুকিয়ে যায় মাথা ও শরীর । এবার কাপড় চুরি করতে হবে।
সবাই মিলে একজনকে দায়িত্ত্ব দেওয়া হল। বাহিরে সবাই অপেক্ষা করছে। সে পাক্কা চোরের মত আছতে করে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো মান্নানদের বাড়িতে। বয়স্ক বুড়ি মানুষটি কাপড় গুলিকে বারান্দায় রেখে নিজ ঘরে শুয়ে পড়েছে।
চোরের মত ধির পায়ে ছেলেটি এগিয়ে গেল কাপড়ের দিকে। কাপড়ের দিকে খেয়াল থাকায় তার পায়ের সাথে পার্শে রাখা থালা বাসুনের সাথে ধাক্কা লাগে। ঘর থেকে বুড়ি বলল --- কে রে...?
চোর মাথা খাটিয়ে বলল...
হামি দাদি।
মান্নান?
হুঁ।
কি কচ্ছিস?
কিছু লয়। বলতে বলতে সব কাপড় গুটিয়ে দে দৌড়।
বাইরে বেরিয়ে যে যার কাপড় তাড়াতাড়ি পরে সবে মাত্র ডহরে ( গ্রামের কাঁচা রাস্তা) উঠেছে, অমনি একটি জীপ গাড়ি গ্রামের মধ্যে দিয়ে ধুলা উড়িয়ে ছুটে এলো।
সবাই আবার ছুটলো সেই গাড়ির পিছু পিছু। গাড়ি গিয়ে থামল সিংড়া পুকুর পাড়ে। গাড়ির পেছন পেছন ছুটতে গিয়ে আবার সবার চেহারা মাটির মুর্তির মত দেখাচ্ছে।
তবুও তারা খুশি। গ্রামে একটা জীপ গাড়ি ঢুকেছে। এসব গাড়ি সাধারনত এমন গ্রাম অঞ্চলে আসেনা। ফলে এসব ছেলেরাও তেমন পরিচিত নয়।
গাড়ির দরজা খুলে কাল চশমা পরা স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক নামলেন। চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন। কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তাই তার প্রথমে চিনতে অসুবিধা হল, তিনি ছেলেদেরকে ডেকে বললেন---
বাবু এই গ্রামের নাম কি?
ছেলেরা বলল-- বইতপুর,
এবার তার ছোট্ট বেলার কথা মনে হল। হ্যাঁ তার গ্রামের নাম ছিল বইতপুর।
কিন্তু কাগজে সে দেখেছে বৈদ্যপুর তাই বুঝতে পারেনি যে এটি তারই গ্রাম।
------------------------
মনা অফিসে যোগদান করার পর ২নং বাধাইড় ইউনিয়নের চেয়ার ম্যান লুতফার রহমানের একটি আবেদন দেখেছিল। সেই আবেদনে বৈদ্যপুর গ্রামের সিংড়া পুকুর পাড়ে রাস্তায় কালভাট নির্মানের অনুরোধ করা হয়।
সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে রাজশাহী বরেন্দ্র অফিস হতে কালভাট টি বরাদ্দ হয়। আর সেটির কাজ তদারকি করতে এসেছেন ইঞ্জিনিয়ার মইনুল ইসলাম মনা।
এটা যে তারই গ্রাম, এখানে সে জন্ম গ্রহন করেছে। আজ তারই গ্রামে সে কাজ পরিদর্শন করতে এসেছে। সুতরাং কাজ খারাপ হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না।
ইঞ্জিনিয়ারকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে, মিস্ত্রীদের থাকা টিনের কুঁড়ে ঘর থেকে হেড মিস্ত্রী বেরিয়ে এল।
ইঞ্জিনিয়ারঃ হেড মিস্ত্রী কে? আপনি কাজ করছেন?
মিস্ত্রীঃ জী স্যার।
ইঞ্জিনিয়ারঃ চলুন মাপটা দেখি।
মিস্ত্রী মাপার জন্য ফিতা টেপ নিয়ে এল।
তারপর ব্রিজের দৈঘ্য প্রস্থ্য উচ্চতা সব মাপা হল, কোথায় এক ইঞ্চি কম কথায় ঢালাই ভাল হয়নি ইত্যাদি ভিবিন্ন কিছু ভুল ধরার পর , তিনি নিজে মিস্ত্রীর মসলা বানানো বাক্সটির কাছে গেলেন। বাক্সটি মেপে দেখলেন মাপ দুই ইঞ্চি বেশি আছে। বাক্সের ওপর দিকে দুই ইঞ্চি আলাদা কাঠ লাগানো আছে।
রাগে তিনি নিজের পা দিয়ে লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেললেন বাক্সের সেই অংশটি।
হেড মিস্ত্রী ভয়ে কাঁপছিল। ছেলে গুলি চারিদিকে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল প্রথম থেকেই।
তিনি মিস্ত্রীকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে বললেন, কন্টাকটরকে বলবে আমার মতে কাজ না হলে এক পয়সাও বিল পাবে না।
ইতি মধ্যে গ্রামের কিছু বড় মানুষ সেখানে এসে জড় হয়েছে।
ইঞ্জিনিয়ার তাদের অনেককেই চিনতে পারলেন, কিন্তু গ্রামের কেহই সেই ইঞ্জিনিয়ারকে চিনতে পারলো না। তিনি বললেন আমি আগামী সপ্তাহে আবার আসবো। এর মধ্যে যেন সব কিছু ঠিকঠাক পাই। বলে গাড়িতে উঠে আবার নিজ অফিসের দিকে চলে গেলেন, ছেলেরাও গাড়ির পিছু পিছু অনেকদুর দৌড়িয়ে গেল।
-----------------
ঠিক আটদিন পর সেই জীপগাড়ী আবার গ্রামের রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে ছুটে এল। তখন বেলা এগারটার মত হবে। তাই গ্রামের লোকজন তখন বাড়িতে বা এগাছ ওগাছ এর নিচে বসে গল্প গুজব করছিল। তাছাড়া আগেই রটে গিয়েছিল আটদিন পর কাল্ভাট দেখতে অফিসার আসবে।
বহু লোক ছুটে গেল সেখানে। এই আটদিনে মিস্ত্রী সবকিছু ঠিক ঠাক করেছেন। তার পরও কাজ তার মন মত না হওয়ায় বেশ কটি কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন। তারপর গ্রামের লোকদের উদ্দেশ্যে কথা বলার জন্য চশমা খুললেন। এবার কয়েকজন যুবক বলা বলি করতে লাগল,
----আরে এই লোক ছয় বছর আগে ট্রেনের উপর হামারেক ট্যাকা দিলঝেলো না। পাওরুটি কিন্যা খাওয়ালো, হামরা যখন নাটর যাচ্ছিনু। একি কন্ঠ, একি চেহারা। তাই তাদের মধ্যে একজন সাহস করে বলল—
স্যার, হামারেক চিনতে প্যারছেন, হামরা নাটোর যাচ্ছিনু ট্রেনেত, আপনি পাওরুটি কিন্যা খাওয়ালঝেলেন।
ইঞ্জিনিয়ারঃ ওহ, আচ্ছা। তোমাদের সাথের সেই অন্ধ ছেলেটা কৈ?
পেছন থেকে সেই অন্ধ ছেলেটা এগিয়ে এল।
কাছে এলে ইঞ্জিনিয়ার সেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। তারপর বললেন মনে পড়ে সেই দিনের কথা----- যেদিন তোমার চোখ অন্ধ হয়েছিল?
তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি সেই মনা, যার ডাংগুলির আঘাতে এর চোখটি অন্ধ হয়েছিল, কিন্তু বিচারে এই মানুষ গুলি আমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষি দিয়েছিল। আমার বাবা জরিমানার টাকা দিতে পারেনি বলে আমাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি এদের কারনে , আমার মা ভাইবোন কোথায়? মনার দু’চো বেয়ে জল গড়িয়ে এল।
ভিড়ের মধ্যে থেকে এক বৃদ্ধ মানুষ এগিয়ে এসে বললেন,
-বাবা হামি সেদিন তুমারেক বাঁচ্যাতে পারিনি। অরা তুমারে বাড়িত আগুল লাগায়্যা দিলঝেলো, তুমার ভাই বৈন আর মায়েক হামি পাল্যায়া কোলেত থুয়্যা আলঝিনু। তুমার মাও ছয় বছর আগে মর্যা গেলঝে। তোমার বৈন, ভাইএর বিয়া হলঝে, ওরা ইয়াসিন হাজীর বাড়িত থাকে।
এবার মনা বুড়োকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন—
সেদিন শুধুমাত্র এই মানুষটি সত্য কথা বলেছিল, কিন্তু কেউ তার কথার দাম দেন নি।
জনতার মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল—
যারা সেদিন বিচ্যার করিছিল কেউ ব্যাঁচা নাই।
মনা বলল-
আপনাদের উপোর আমার কোন অভিযোগ নাই, আপনারা আমার প্রতি অন্যায় করেছেন সেজন্য আমি আমার বাবা-মাকে হারিয়েছি, কিন্তু আমার আল্লাহ আমাকে আরও দু’জন করে বাবা-মা দিয়েছেন, তাদের প্রচেষ্টায় আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি।
কেউ একজন একটি কাঠের চেয়ার এনেছিল ইঞ্জিনিয়ারকে বসতে দেবার জন্য। অনেক লোক জায়গা কম তাই ইঞ্জিনিয়ার গাড়ি ঘুরিয়ে কাশেমের খলিয়ানে এসে নামলেন। এখানে অনেক বড় জায়গা। বড় আমগাছটির নিছে বসলো মনা, তাকে ঘিরে গোল হয়ে মাটিতেই বসে পড়ল লোকজন, আজ মনার মুখে তার জীবনের ঘটনা শুনতে চায় সবাই।
মনা প্রায় দুই ঘন্টা ধরে তার জীবনের ইতিহাস শুনালো গ্রামের লোকজন কে। তার পর সেই বুড়ো চাচাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন কোয়েল গ্রামে তার ভাই বোন্দের সাথে দেখা করতে। উপস্থিত সবাই তখন নিজেদের চোখ মুছতে মুছতে যে যার বাড়ির দিকে চলে গেল।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন