ধারাবাহিক উপন্যাসঃ ছেঁড়া চিরকুট পর্বঃ (ছয় )
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ “ছেঁড়া চিরকুট”
---------খোশবুর আলী
পর্বঃ০৬
তারিখঃ
খুব সকাল সকাল বাড়িতে লোকজনের কোলাহল শুনে রুহুল ঘুম থেকে জেগে উঠল।চোখ কচলাতে কচলাতে ঘর থেকে বের হয়ে শুনতে পেল তাদের বাড়িতে রাত্রে চোর এসেছিল। লোকজন বলাবলি করছিল রুহুল অনেক রাত জেগে পড়াশোনা করছিল তাই আজ চোর চুরি করতে পারেনি।সবাই রুহুলকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল।এবার রুহুলের মনে পড়ল, সে তার মাকে সন্ধ্যায় সাবধান করেছিল। আর সে কারণেই হইতো চোর চুরি করতে পারেনি। রুহুল মনে মনে খুব খুশি হয়ে কলপাড়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়েনিল। এরপর মায়ের নিকট গিয়ে বলল—
রুহুলঃ দ্যাঘমা, হামার কধা শুন্যা তুমি গুয়্যাল না দেখলে আজ কি সর্বনাশ হতো।
মাঃ হ্যাঁরে ব্যাটা, তুর কধা ভুলাই গেলঝিনু। এক চমক নিন পাড়ার পর উঢ্যা দেখি তুর ঘরেত আলো জ্বলছে, কিন্ত পড়ার শব্দ প্যানুন্যা, তাই উঢ্যা তুর ঘরের যায়্যা হারিকেল লিয়্যা আসছিনু। তঘুনি গুয়্যালেত হুটমুট শব্দ শুন্যা দেখতে গেনু। অমনি হামাক দেঘ্যা চোর পাল্যায়া গেল দরজা দিয়্যা।
অনেক মেয়ে পুরুষ তাদের মায়েবেটার এসব কথা শুনছিল। সবাই রুহুলকে বাহাবা দিচ্ছিল। এতে রুহুল বেশ খুশি হল। আজ স্বপ্নে চামেলী তার কাছে আসেনি বা সে চামেলীর কাছে যায় নি। কিন্তু চমতকার একটি ঘটনা ঘটেগেছে তাদের বাড়িতে। এতে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো চারিদিক আরও। রুহুল আরো ভাবলো চামেলীর দেয়া চিরকুট তার বেশ পরির্বতন এনে দিয়াছে। ক্লাসের পড়াও ভালই হয়েছে। সে কিছুই নিজে না করতেই চারিদিক তার এতো সুনাম শুনতে বেশ ভালই লাগছে। ফলে সেই চিরকুট আর চামেলীর অবদান তাঁর নিকট আরও গুরুত্তপূর্ণ হয়ে উঠল।
রুহুল দৌড়ে ঘরে গেল। ব্যাগের পকেট দেখল, হ্যাঁ , সেই চিরকুট দুটো যায়গামতই আছে। কিন্তু বাড়িতে অনেক মানুষ তাই বের করলো না। শুধু মনে মনে কয়েকবার পড়ে নিল। তাঁর মুখস্থ থাকার কারণে পড়তে কোন অসুবিধাই হল না।
এবার ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়তে বসল। রুহুলকে পড়তে দেখে অনেকেই বলল, রুহুলের মা, তোমার ব্যাটা যেই পড়া পৈড়ছে, দেঘো ভবিষ্যতে খুব বড় একটা চাকরী বাকরী না কর্যা ছ্যাড়বে না।
শুনে রুহুলের মায়ের গর্বে বুকটা ভরে গেল। রুহুলের মা বললঃ-
তোমরা বসো গে সবাই হামি লাহারি তয়্যার করি খ্যায়া যাইও। বলে থালা বাসুন নিয়ে কলপাড়ের দিকে গেলেন সেগুলি মাজতে। ফলে পাড়া পড়শিরাও একে একে তাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষনের মধ্যে সবাই চলে গেলে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। এবার রুহুল চিরকুট দুটো বের করে সামনে রাখলো। ইতিমধ্যে তার দুটো বইয়ের পড়া হয়ে গেছে। বইদুটো সেটে সে চিরকুটের উপর নজর দিল।
দেখে দেখে আরও কয়েক বার পড়ে আবার যত্ন করে ব্যাগের পকেটে রেখে দিল। আজ তার মনটাও বেশ ফুরফুরে। কারণ ভালো ঘুম হয়েছে। রাতে আর সকালে মিলে প্রায় পাঁচটি বিষয়ে ক্লাসের পড়া তার তৈরি হয়েছে। ফলে সে হাতের লেখাগুলি সেরে ফেলার জন্য খাতা কলম বের করল। বাংলা , ইংরেজী খাতা লেখার পর অংক করতে লাগল। কিন্তু এর আগে সে কোনদিন বাড়িতে অংক করেনি। তাই ভাল ভাবে অংক করতে পারলো না।
বই খাতাপত্র গুটিয়ে এবার সে বাহিরে বেরিয়ে গেল। বাহিরে জনিসহ আরও কয়েকজন সহপাটির সাথে তার দেখা হলো। জনিই প্রথমে বলল—
-কিরে রুহুল? খুব বুলে রাত জ্যাগা পৈড়ছিস? তাহেলে এবের রুল এক না কৈরা ছাড়বু ন্যা মুনে হয়। ইদানিং দেখছি তুই হামারেক লুক্যায়া লুক্যায়া কি কি সব কৈরছিস। ভালো কৈরা হামারে সাথে কধাও বুলিশন্যা। ব্যাপারডা কি? তুই কি কুনু জাদু মুন্তর শিখলু নাকি কারু কাছে।
রুহুল দেখলো, জনি আসল কথায় বলে ফেলেছে। তাই কথা কাটাবার জন্য বলল—
-নারে ভাই। হ্যামিতো ভালো পড়ালেখা পারিন্যা। প্রতিদিন স্কুলেত ম্যার খায়। তাই একটু পড়ার চেষ্টা করছি আরকি। তুরা ব্রিলিয়্যান্ট ছাত্র, হামিতো মাধাপচা। বেশী না পড়লে কিছুই পারি ন্যা।
জনিঃ ঠিক আছে পড়। হামরাও চেষ্টা করি, দেখি কে রুল এক কৈরতে পারে?
রুহুলঃ নারে ভাই। তুরে সাথে হামি টেক্কা দিতে পরি? ম্যার বাঁচান্যার কারণে একটু পৈড়ছি আরকি। দোয়া করিস ভাই। যান কিছু শিখতে পারি।
জনিঃ আচ্ছা। হামারে কারণেও দুয়া করিস। বলে চলে গেল।
জনি চলে গেলে রুহুল বাড়ি ফিরে এলো। মা প্রাতকালীন কাজকর্ম সারছিলেন। রুহুলের বাবাও খলিয়ানে তাদের গরুগুলিকে খাবার জন্য খড় কেটে দিচ্ছিলেন। এখুনও সকালের নাস্তার সময় হয়নি। রুহুল সাধারনত এমন সময় ঘুম থেকে উঠেনা। আজ নিদারুন এক ঘটনা ঘটে যাওয়ার কারণে সে সকাল সকাল উঠেছে। সময় আছে দেখে সে তার ঘরে ফিরে গেল।
টেবিল থেকে ব্যাগটা নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো। ব্যাগ খুললেই এখুন তাঁর অবশ্যকর্তবীয় হল চিরকুটটা কয়েক বারপড়া। এখুনও তার ব্যাত্যই ঘটলনা। এরপর রাতের পড়াগুলি সে রিভাইজ করে নিল। বেশ ভালই লাগছে তাঁর। আসোলে ক্লাসের পড়া পারার মজাই আলাদা। সে গনিতে একেবারে কাঁচা। তাই সমাধান বের করে। দেখে দেখে আজকের মত গনিতের খাতাটি ভরে ফেললো। এবার খাতা বইসেটে সমাধানটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলো।
সে কিছু কিছু অংক বুঝতে পারছে। কিন্তু পুরোপুরি নয়। তারপরেও কয়েকবার পড়লো। এবার সে চোখ বন্ধ করে ভাবলেই পুরো অংকই যেন তার মানষ্পটে ভেসে উঠছে। উৎসাহ ভরে সে আবার তার গনিতের খাতাটা বেব করে না দেখেই একটা অংক করে ফেললো। তারপর সমাধান বইটা বের করে মিলিয়ে নিল। বাহ! পুরোপুরি মিলে গেছে। আনন্দে সে গান গাইতে লাগল।
এবার সে পরেরটার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। এবারও সফল হল। এভাবে সে সেদিনের পাঁচটি অংকই মুখস্ত করে ফেললো।
কিচ্ছুক্ষন পরে মা খাবার খেতে ডাকলো। তাই বইপত্র সেটে খাবার খেতে এলো। নাস্তা সেরে পোশাক পরে স্কুলে যাবার জন্য রেডি হল। এর মধ্যে তার কয়েকজন সহপাঠি স্কুলে যাবার জন্য ডাকতে চলে এসেছে। স্কুল তিন কিলোমিটার দুরে হওয়ায় সবছেলে মেয়েরা একসাথে পাঁয়ে হেটে স্কুলে যায়। বৈদ্যপুর থেকে কৈল হাট পর্যন্ত মেঠোপথটি সবেমাত্র মাটি কেটে উচু করা হয়েছে। দু’পাশে শিশুগাছও লাগানো হয়েছে। রাস্তার পাশের সদ্য বেড়ে ওঠা ডালপালা মেলে কে কার উপর উঠতে পারে সেই প্রতিযোগীতায় নেমেছে। চৈত্রের ধুধুখরার পরে একপসলা বৃষ্টি হয়েছে দুনিন আগে। আর সেই সুবাদে গাছ গুলিতে নতুন কচিকচি পাতার পাখনা মেলে উড়তে চাইছে আকাশ পানে। মাঝে মাঝে হালকা হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে যেন স্বাগত জানায় পথিকদের। এমনিতেই আজ রুহুলের ফুরফুরে মেজাজ। তার উপর পরিবেশের এমন সুন্দর আকুতি তাকে আরও রোমান্টিক করে তুলছে। বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে সেই মেঠো পথ ধরে হাঁটছিল তার। কিন্তু রুহুলের মনের প্রেমোময় ছন্দ তখন গাছপালা আর হাওয়ার সাথে ঢেউএর মত উথলিয়ে উঠছিল তাঁর সহপাঠিরা তা ঘুনাক্ষরেও টের পেলনা।
সেদিন রুহুলের আর কোন কিছু খোজা হলনা। ক্লাসের বন্ধুরা আজ কেমন যেন তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। রুহুল একটু সময় পেলে এদিক ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করলেই তারাও তার সাথে সাথে চলে আসছে।
সময় মত ক্লাস শুরু হল। প্রথম ও দ্বিতীয় পিরিয়ড ভালো ভাবেই হলো। তৃতীয় পিরিয়ডে আসলেন গনিতের স্যার, আব্দুর রহীম বিএসসি স্যার। বেশ দির্ঘ্যদেহি স্বাস্থবান মানুষ। দেশের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার উনুপ নগর গ্রামে। স্কুলের বেশীর ভাগ শিক্ষকই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার। স্থানীয় স্যার বলতে ছিলেন আব্দুর রশীদ স্যার এবং নুরমোহাম্মাদ কেরানী স্যার। আব্দুর রহীম বিএসসি স্যার ছিলেন খুব কড়া মেজাজি। মুখে দাড়ি রাখতেন না তবে বেশ ঘোঁফ রাখতেন মাশাআল্লাহ। লাঠি হাতে পায়চারি করতেন বারান্দায়। ক্লাসেও আসতেন লাঠি নিয়ে। রুহুল গনিতে কাঁচা, স্যার জানেন। প্রায় প্রতিদিনই এই স্যারের হাতে মার নাহয় বকুনি খেত। দিয়াড়া ভাষায় বেশ কড়া করে বকতেন। বলতেন—হায়াপর্দা নাই নাকি তোরঘে, অংক না কর্যা ক্লাছে আছিস ক্যানে।
আজ রুহুল অংক মুখস্ত করেছে। বাড়িতে অংক করেছে। কিন্তু আজ ছিল বুধবার। আজ কিন্তু পাটিগনিত ক্লাস হয়না। সপ্তাহে দুইদিন বুধ ও বৃহস্পতিবার জ্যামিতি ক্লাস হয়। ষষ্ঠ শ্রেনীতে বীজগনিত ছিল না। বীজগনিত ছিল সপ্তম শ্রেণী থেকে।
জ্যামিতি সবাই বোঝেনা। বেশির ভাগ ছাত্র- ছাত্রী ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আসল রুহুলের পালা। রুহুল দাঁড়িয়ে সাধারনত মাথানিচু করে থাকে। আজ খুব দৃঢ়তার সাথে বলল---
স্যার আজ আমি বুধবার হামার মনে ছিল না। তাই অংক কর্যা অ্যালঝি ,জ্যামিতি পড়া হয়নি।
স্যার বললেন- কি দিয়্যা ভাত খায়্যাছিস মনে আছে তো? নাকি সেটাও ভুল্যা বছ্যা আছিছ। মিথ্যা কথা ক্যানে কহছিত। হাঁকে একখান অংক কর্যা দ্যাখা তো?
রুহুল বলল- স্যার, কয় নাম্বার কৈরব?
স্যারঃ ছয় নাম্বারটায় করতো দেখি।
রুহুলঃ আচ্ছা স্যার, বলে করতে শুরু করলো। পাঁচ মিনিটের ,মধ্যে অংক করে খাতা দেখাতে গেল। স্যার দেখে বুঝলেন, রুহুল মিথ্যা বলেনি। তার অংক সঠিক হয়েছে। তাই তাকে ধন্যবাদ দিলেন এবং সিটে গিয়ে বসতে বললেন।
এবার স্যার বাঁকিদের কয়েকটি করে উত্তম মধ্যম দিলেন। সবাই নিজ নিজ হাত ডলছিল আর উহ, ইশ, শব্দ করে নিজের সিটে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছিল। স্যার ধমক দিয়ে থামতে বললেন এবং নিজে বোর্ডে জ্যানিতি বোঝাতে লাগলেন।
বোঝানো শেষে স্যার আবার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশ্ন করে শিয়র হলেন যেন তারা ঠিক মত বুঝলো কি না।
রুহুল বললঃ স্যার, আর একবার শুরু থ্যাক্যা বুললে ভালো হৈতো।
স্যারঃ ঠিক আছে, হামি আরেকবার কহছি, ভালো কর্যা দ্যাখ।
স্যার আবার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বোঝালেন। এবার স্যার বললেন—
কে পারবি বোর্ডে অ্যাছা হাঁকে জ্যামিতি খান কৈর্যা দেখা তো?
রুহুল বীর দর্পে উঠে এলো এবং গড়গড় করে স্যারের মত করেই গোটা জ্যামিতিটা বলে ফেলল। স্যার মুচকি হেসে ধন্যবাদ দিয়ে বসতে বললেন। সবাই আশ্চর্য হল। কিন্তু রুহুল মনে মনে পকেটে রাখা চিরকুটটাকে একবার ধন্যবাদ না দিয়ে পারলো না। ধন্যবাদ দিল চামেলীকেও।
---------চলবে----- আগামী পর্বঃ ০৭ , সাথে থাকবেন আশাকরি।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন