ধারাবাহিক উপন্যাসঃ- ডাঙ্গুলী ---- খোশবুর আলী ( পর্বঃ-০৪ )
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সোহেল চৌধুরী মনাকে তাঁর সীটে বসিয়ে রেখে তাঁর বাবাকে খোঁজার জন্য উঠে গেলেন। বললেন- আমি না আসা পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে, কেউ ডাকলেও যাবে না, কিছু দিলে নিবে না, ঠিক আছে? ট্রেন ছাড়ার আগেই আমি ফিরে আসবো।
প্রতিটি ট্রেনে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। এর মধ্যে যেমন কিছু ভাল মানুষ থাকেন তেমন অনেক খারাপ মানুষও থাকে। রাজশাহী সিরোইল ইস্টেশান থেকেই মনাকে দু’টি লোক অনুসরণ করছিল। এরা চোরা কারবারী। অসহায় নারী বা শিশুদেরকে এরা সুযোগ বুঝে ভারতে পাচার করে। সোহেল চৌধুরীকে মনার নিকট থেকে সরে যেতে দেখেই তাদের মধ্যের একজন মনার নিকট এগিয়ে এল। লোকটির গায়ের পোশাক ঝকঝকে। বড় বড় গোঁফ। মাথায় বেশ লম্বা চুল। সে মনার কাছে এসে হাসি মুখে মনাকে জিজ্ঞাসা করল—
তোমার নাম কি বাবু?
মনাঃ মনা।
লোকটিঃ তোমার বাবা কোথায়?
মনাঃ জানিন্যা।
লোকটিঃ যে লোকটা তোমাকে রুটি কিনে দিল সে তোমার কে হয়?
মনাঃ জানিন্যা। হামাক কাকা ব্যুলতে বুলিছেলো হামার আব্বা।
লোকটিঃ ও আচ্ছা। আমি বসি এখানে তোমার পাশে?
মনা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলে লোকটি বসে পড়লো।
কথা আর মিষ্টি হাসি দিয়ে লোকটি মনার সাথে ভাব জমাতে শুরু করলো।
এবার লোকটি তাঁর পকেট থেকে দু’টি চকলেট বের করে মনাকে দিতে চাইল। কিন্তু মনা নিতে চাইল না। সে বলল—
বাবু নাও। কোন অসুবিধা নাই। আমিও তোমাত কাকা হই। যে লোকটা তোমাকে এখানে বসে থাকতে বলল না, ও তো আমারি বড় ভাই। ওর রুটি খাওয়া হলে আমার চকলেট খেতে অসুবিধা কোথায়?
মনাঃ না।
এবার তাঁর সাথি লোকটি এগিয়ে এসে বলল—
হ্যাঁ বাবু আমিও চিনি। এরা দুই ভাই হয়। নাও চকলেট খাও , কোন অসুবিধা নাই।
মনা হাত বাড়িয়ে নিচ্ছে না দেখে প্রথম লোকটি নিজেই তাঁর হাতে গুঁজে দিলেন। আর নিজ হাতে একটি চকলেট খুলে মনার মুখে দিয়ে দিলেন। মনাও ততোক্ষণে তাদেরকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। মনা চকলেট চুষে কয়েকটা ডোক গিলতেই কেমন যেন মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। মনা আজ রাতে ঘুমাতে পারে নি, আবার অনেক পথ পায়ে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, ফলে সে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল।
সোহেল চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষে গেলেন ষ্টেশন মাষ্টারের কক্ষে খোঁজ করার জন্য। ষ্টেশন মাষ্টারকে সব কথা খুলে বললেন। তাই ষ্টেশন মাষ্টার রাজশাহী সিরোইল ষ্টেশানে টেলিফোন করলেন।
অপর প্রান্ত থেকে বলা বল একজন লোক নাটোর গামী ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়েছেন, তাঁর হাতে দু’টি পাওরুটি ও এক হালি কলা ছিল, গায়ে নিল রঙের জামা ছিল। স্থানিয় কেউ তাকে চিনতে পারেনি, তাই আমরাও তাঁর কোন পরিচয় জানতে পারিনি। ফলে আমরা পুলিশ ডেকে লাশ ময়না তদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেলে পাঠিয়েছি।
সোহেল চৌধুরীর অনেকটা সন্দেহ হল, মনার বাবা নয় তো? কিন্তু মনাকে তার নিকট রেখে যাওয়ার সময় কেমন রঙের শার্ট পরে ছিল মনে করতে পারল না। তাই সিদ্ধান্ত নিল, মনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তাঁর বাবার গায়ে কেমন রঙের জামা ছিল?
তাই তিনি ছুটে চললেন গাড়ির দিকে। ততক্ষণে ট্রেন হুইসেল দিয়ে চলতে শুরু করেছে। তিনি তড়িঘড়ি ট্রেনে উঠতে গিয়ে লক্ষই করতে পারলেন না দু’টি লোক অন্য দরজা দিয়ে একটি ঘুমন্ত শিশুকে কাঁধে করে গাড়ি থেকে নেমে গেল।
সোহেল চৌধুরী লোকজনের ভিড় ঠেলে তাঁর সীটের নিকট গিয়ে দেখলেন, সেখানে অন্য লোক বসে আছে, কিন্তু মনা নাই। তাই তিনি সীটে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন—
ভাই, এখানে একটি আট নয় বছরের শিশু ছিলো কোথায় গেল।
লোকটি বললঃ কেন ? আপনার সাথের লোকই ওকে নিয়ে চলে গেল।
সোহেল চৌধুরীঃ আমার সাথের লোক মানে?
লোকটি বললঃ ওরা তো তাই বলল। শিশুটিকে চকলেট খাওয়াল। কোলে নিয়ে আদর করল, তারপর শিশুটি ঘুমিয়ে গেলে তাঁরা ওকে আপনার নিকট নিয়ে যাবে বলে চলে গেল।
সোহেল চৌধুরীর বুঝতে অসুবিধা হল না যে, মনা, শিশু পাচার কারীর হাতে পড়েছে। কিন্তু ট্রেন ততক্ষনে অনেকদুর চলে গেছে।
সোহেল চৌধুরীর মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। একজন কে খুঁজতে গিয়ে আরেক জনকে হারিয়ে ফেললাম? একদিকে শিশুটি তাঁর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, তাঁর বাবাকে হারিয়েছে আবার সে নিজেও এখন বিপদের মুখে। কি করা যায়। অনেক কিছু সে তাঁর মানস পটে দেখতে পাচ্ছে। যদি পাচার কারিরা ভারতে পাচার করে ফেলে, তখন তো আর কিছুই করার থাকবে না। আর বাড়ি গিয়ে কোন ব্যবস্থা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে, তাই সে সিদ্ধান্ত নিল সামনের বাঘা ষ্টেশনে নেমে বাঘা থানায় একটি ডায়রি করবেন। প্রত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি দিবেন কিছু পুরস্কারের ঘোষনা দিয়ে। যদি তাঁর পাতা ফাঁদে পা দেয় পাচার কারীরা।
কিছুক্ষন পরেই ট্রেন বাঘা ষ্টেশানে এসে থামল।
সোহেল চৌধুরী নেমে একটি রিক্সা ডেকে ছুটলেন বাঘা থানায়।
থানায় গিয়ে অসি সাহেবের রুমে ঢুকতেই সে হতবাক।
একি, অসির চেয়ারে বসা পুলিশ অফিসার তাঁর কলেজের বন্ধু মারুফ।
পুলিশ অফিসার ওঠে দাঁড়িয়ে বলল-
আরে সোহেল কেমন আছিস? কি মনে করে হঠাত আমার অফিসে? কি করে জানলি আমি এখানে পোষ্টিং পেয়েছি। তোর মুখটা এমন শুকনা কেন? কোন বিপদ আপদ হয়েছে নাকি?
সোহেল চৌধুরীঃ আরে থাম থাম। এক সাথে এতো প্রশ্ন করলে উত্তর দেব কোনটার।
পুলিশ অফিসারঃ তোর কোন উত্তর দিতে হবে না। বস চা খা। পরে শুনব তোর কথা। সেট্রি; আমার রুমে দু কাপ চা আর বিস্কুট পাঠাও।
সেন্ট্রি ওকে স্যার বলে চলে গেল।
সোহেল চৌধুরী ট্রেনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলল পুলিশ অফিসার কে। আর অনুরোধ করল বন্ধু যে করেই হোক শিশুটিকে উদ্ধার করতেই হবে তোকে।
পুলিশ অফিসারঃ চিন্তার কারন নাই বন্ধু, আমি প্রথমে বর্ডার এরিয়া গুলিকে সাবধান করে দিচ্ছি। আমাদের এলাকায় একটি গ্রুপ নারী ও শিশু পাচার করছে বলে আমরা খবর পেয়েছি কিন্তু কেউ আমাদের নিকট অভিযোগ নিয়ে আসেনি ফলে আমরা কোন ব্যাবস্থা নিতে পারিনি। আজ তুই যখন অভিযোগ করলি, তাহলে এক কাজ কর থানার পাসেই দৈনিক সোনালী সংবাদের অফিস আছে ওখানে পত্রিকায় একটি মিসিং বিজ্ঞপ্তি দিবি, তাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরোস্কারের ঘোষনা দিবি। আর তোর বাসার ফোন নাম্বার দিয়ে দিবি। পাচার কারীরা লোভে হয়ত ফোন করতেও পারে। ফোন করলেই আমাকে জানাবি। এর পর আমার কথা মত কাজ করলেই আমরা তাদের কে ধরে ফেলবো ইনশাআল্লাহ। এর মধ্যে চা বিস্কুট এলো। পুলিশ অফিসার রাইটার মুন্সীকে একটি মিসিং মামলার আবেদন লিখতে বললেন। দুজনে চা খেতে থাকলেন, এরি মাঝে মুন্সি লিখিত আবেদনটি নিয়ে আসলে তাতে সোহেল চৌধুরীর স্বাক্ষর করতে বললেন। সোহেল চৌধুরী স্বাক্ষর করলে, সেটি সেকেন্ড অফিসারকে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে পুলিশ অফিসার মারুফ, সোহেল চৌধুরীকে নিয়ে পত্রিকা অফিসে গিয়ে কথামত একটি বিজ্ঞপ্তি দিলেন। এবং সোহেল চৌধুরী অফিসার বন্ধুর নিকট হতে বিদায় নিলেন। ষ্টেশানে এসে পরের গাড়িতে তিনি বাড়ি ফিরে আসলেন। বাড়ি পৌছাতে তাঁর রাত প্রায় দশটা বেজে গেল।
_____চলবে___আগামী পর্ব-০৫
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন